সাহায্য প্রয়োজন?
       ডিউটি অফিসার
: ০১৭৪৫৭৭৪৪৮৭, ০২-৪৮১১৮৫৪২
হটলাইন: ০১৩২০-০৪২০৮৫
ইমেইল
: vsc.dmp@dmp.gov.bd

আদুরী

সংবাদপত্রের পাতায় হঠাৎই উঠে আসে এক অ-সুন্দর শিরোনাম "ডাস্টবিনে পড়ে থাকা মানবতা"। অনেকেই হয়তো রোজকার অভ্যাসের তাগিদে গরম পেয়ালাটি হাতে নিয়ে পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে খবরটি পড়েছেন। খবরটি পড়ার ফাঁকে হয়তো অনেকেই দু ফোঁটা চোখের জলও ফেলেছেন শিশুটির উপর করা অমানবিক নির্যাতনের নিদর্শন দেখে। কে এই শিশু? কি তার পরিচয়? কে, কিভাবে শিশুটিকে নির্যাতন করেছে? এতগুলো প্রশ্নের মাঝে যখন সকলেই দ্বিধান্বিত হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অস্পষ্ট ক্ষীণ স্বরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টরের কর্মকর্তাদের শিশুটি জানায় যে তার নাম আদুরী। বাবার নাম আঃ খালেক মৃধা, মা সাফিয়া খাতুন, বাড়ীঃ পটুয়াখালী। এছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না, এমনকি সে যে বাসায় কাজ করতো তার ঠিকানাও বলতে পারে না। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা আদুরী নামের এই শিশুটিকে অচেতন অবস্থায় বারিধারা ডিওএইচএস এর একটি আস্ত্মাকুড় থেকে উদ্ধার করে পুলিশের একজন সদস্য।
গত ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১৩, দিনটি ছিল স্বাভাবিক নিয়মের একটু বাইরে। ক্যান্টনমেন্ট থানার এএসআই/আঃ মান্নান দিবাকলীন টহল ডিউটিরত অবস্থায় ডিওএইচএস এলাকার রেললাইনের পাশে একটি ডাস্টবিনের কাছে আনুমানিক দশ বছরের একটি মেয়ে শিশুকে জীবনমৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। আশেপাশের লোকজনের সহায়তায় মুমূর্ষু শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দ্রুত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন এবং বিকাল আনুমানিক ৪.৩০ ঘটিকায় ২০৪ নং ওয়ার্ডের বারান্দায় ঠিকানা বিহীন ভিকটিম আদুরীর ঠাঁই মেলে ও প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ পায়। ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) মহোদয়ের নির্দেশক্রমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নারী ও শিশুর জন্য পেশাগত সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কুইক রেসপন্স টিম তাৎÿনিকভাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিশু ভিকটিম আদুরীকে খুঁজে বের করে ও ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। শিশুটির দেখাশোনা ও নিরাপত্তা প্রদানের জন্য দিনরাত ২৪ ঘন্টার যাবতীয় দায়িত্বভার নেয় এই ডিভিশন।
তিন দিন ২০৪নং ওয়ার্ডে অবস্থানের পর নিবিড় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ভিএসসি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে গত ২৬শে সেপ্টেম্বর সকালে তাকে ওসিসিতে (ওয়ান-স্টপ-ক্রাইসিস সেন্টার) স্থানান্তরিত করা হয়। ইতোমধ্যে পটুয়াখালীতে অবস্থানরত আদুরীর মা পত্রিকার খবর ও অন্যান্য মাধ্যমে মেয়ের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে জেনে ঐদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে পৌছায়। আদুরীর গৃহকর্মে নিয়োজিত হওয়ার বিস্ত্মারিত তথ্য তার পরিবার ও অন্যান্য গোপন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরে পলস্নবী থানার সহযোগিতায় ডবিস্নউএসএন্ডআইডির পুলিশ কর্মকর্তা নির্যাতনকারী গৃহকর্মী নওরিন জাহান নদী (২৪) কে তাৎÿনিকভাবে গ্রেফতার করে ও উক্ত থানায় এ বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে মামলাটি উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে স্থানন্ত্মরিনত হয়। এই ডিভিশনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তদের সার্বক্ষণিক তদারকীতে অত্যন্ত গুরম্নত্ব ও দ্রুততার সাথে মামলার তদন্তকার্য পরিচালনা করা হয়। তদন্তের একপর্যায়ে ইসরাত জাহান (৫০) (অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রীর মা) কে একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অবশেষে গত ১০ই অক্টোবর ২০১৩ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত কার্যক্রম ও প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই দুই জন অভিযুক্তের বিরম্নদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩) এর ৪(১)/৩০ ধারা ও তৎসহ দন্ডবিধির ৩২৬ ধারায় অভিযোগ পত্র দাখিল করেন।

সংসারের অভাবের কারণে দশ ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম আদুরীকে তার বিধবা মা প্রায় একবছর আগে মাত্র পাঁচশত টাকা মাসিক বেতনে উক্ত বাসায় কাজের জন্য পাঠায়। গৃহকর্মে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তার উপর কারণে অকারণে নেমে আসে অমানবিক নির্যাতনের খড়গ। অনাহারে হাড্ডিসার হয়ে যাওয়া আদুরীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় আগুনের ছেকা সহ অনেকগুলো জখমের দাগ। মাথা, ঠোঁট ও মুখমন্ডলে আঘাতের চিহ্ন ছাড়াও রয়েছে নানা অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন।
জীবনমৃত এই শিশু যার নাম আদুরী অথচ জীবনে চলার পথে নামের এতটুকু ছোঁয়া তার জীবনে আসেনি বরং জুটেছে কখনো গরম ইস্ত্রির, কখনো গরম খুন্ত্মির ছ্যাঁকার মত নিষ্ঠুর বর্বরতা। দুবেলা দুমুঠো ভাতের চাহিদা মেটাতে যে মেয়েটি একদিন গরীব মায়ের চোখের আড়াল হয়ে ঢাকায় গৃহ পরিচারিকার কাজ নেয় তাকেই নির্দয় গৃহকর্ত্রী দিনের পর দিন ভাত খেতে দেয়নি, দিলেও ভাতের সাথে শুধু লবণ ও মরিচ জুটেছে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা আদুরীর অস্থিচর্মসার দেহে এসকল হৃদয়হীন নির্মমতার প্রমাণ মেলে। প্রায় দেড় মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ডাক্তারের নিরবিচ্ছন্ন চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পুলিশের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে আদুরী সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আদুরী উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে স্বল্পকালীন অবস্থান করে। এ সময়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জনাব বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) মাহোদয়ের সহৃদয়তায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পÿ হতে আদুরীকে ০৫ টি রিক্সা প্রদান করা হয় এবং পুলিশের কয়েকজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা আদুরীকে এক লক্ষ টাকার নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা
প্রদান করেন। এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে তার পরিবারের জন্য পটুয়াখালীর নিজ এলাকায় জমি ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

    যে আদুরী নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতনে নিস্পেষিত হয়ে ঠাঁই পেয়েছিল আস্তকুঁড়ে, যার জীবন প্রদীপ লোকচÿুর অন্ত্মরালে নিভে যাবারই উপক্রম হয়েছিল পুলিশের মানবিকতা, হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিবেদিত সেবা এবং সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসা এ নৃশংসতার সকরুণ আর্তিতে সে ফিরে এলো এক নতুন জীবনে। আদুরীর পরবর্তী জীবনে এই ধরণের নিষ্ঠুরতা যেন আর না ঘটে, অভাবের তাড়নায় আদুরীর বিধবা মা যেন আর কোন সন্ত্মানকে এ রকম অনিশ্চয়তায় হারিয়ে না ফেলেন সে জন্য অর্থনৈতিক সাবলম্বিতার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছে ডিএমপির কমিশনার মহোদয়ের মানবিক উদ্যোগ।

    আদুরীর জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্বিসহ নির্মম বর্বরতা আমাদের বিবেককে নতজানু করে, প্রশ্নবিদ্ধ করে আমাদের চেতনাকে। আদুরীর এই ভয়াবহ জীবন চিত্র আমাদের মনে প্রতিচ্ছায়া ফেলে চার দেয়ালে বন্দী হাজারো আদুরীর জীবনে বহমান নীরব নির্যাতনের অজানা অ-সংখ্য ঘটনার।

    তাই সময় এসেছে এই অমানবিক নিষ্ঠুরতার বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হবার। আমি, আপনি, আমারা, সকলে মিলে বদলে দিতে পারি আমাদের চারপাশের এই অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর জীবন। যারা এই গ্রহকর্মীদের প্রতি নিষ্ঠুন আচরণ ও শারিবীক নির্যাতন করেন তাদের তথ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকঠ দিয়ে রম্নখতে পারি এ নিষ্ঠুর নির্যানের ভয়াবহতা। একটু মানবিকতা, একটু সহৃদয়তা, আর একটু সহায়তার হাত বাড়ালেই তারা পেতে পারে আলোকিত এক সুন্দর জীবনের ঠিকানা।